প্রবাসীদের দেশের সম্পত্তির প্রতি অসচেতনতা , সমস্যা ও প্রতিকার :

বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি প্রবাসী বিদেশে কর্মরত অবস্থায় দেশে রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও শোষণের শিকার হন। বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫,০০০ এর বেশি সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়, যার ৩৫%ই প্রবাসীদের সাথে জড়িত। এই সংকটের মূলে রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, এবং ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি।

এই ব্লগে আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করবো সমস্যার মূল কারণ, বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা, বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ, এবং সমাধানের উপায়।

সামাজিক প্রেক্ষাপট: মেয়েরা সম্পত্তির মালিক নয়এই মনোভাব এর কারণ :

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এখনও প্রচলিত ধারণা যে মেয়েরা জন্মসূত্রে “পরের সম্পত্তি”। পিতার সম্পত্তিতে তাদের অধিকারকে অনেকেই “অধিকার” হিসেবে দেখে না। ব্র্যাকের ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, ৬৮% পরিবার কন্যা সন্তানের নামে জমির দলিল করেন না, কারণ তারা মনে করেন বিবাহের পর মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি পরিচালনা করবে এবং বিবাহের পরে সে অন্যের সম্পত্তি হয়ে যাবেন।

অন্যদিকে, প্রবাসীরা বিদেশে থাকায় তাদের সম্পত্তি কোথাও কোথাও  “অরক্ষিত” বলে চিহ্নিত হয়।

অনেক আত্মীয়রা এই সুযোগে  জাল দলিল তৈরির মাধ্যমে জমি হস্তগত করে বা করার চেষ্টা করে(ঢাকা জজ কোর্টের ২০২১ সালের ডেটা অনুযায়ী, ৪০% জমি মামলার মূল কারণ জালিয়াতি।

প্রবাসীর পরিবারকে মানসিক ও শারীরিকভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয়  অনেক ক্ষেত্রে।

যেমন- সৌদি আরবে কর্মরত রহিমুল ইসলামের (ছদ্মনাম) স্ত্রী ও দুই মেয়েকে তার ভাই  প্রথম দিকে সব বিষয়ে খেয়াল রাখলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই তার আচরন পরিবর্তন হতে থাকে ।  সম্পত্তির প্রতি লোভ জন্মানোর মানসিকতা থেকে এটি হতে পারে বলে রহিমুল ইসলাম মনে করেন । এই পরিবর্তন রহিমুল ইসলামের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়ায় ,কেনোনা দেশে শুধু তার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ছিল,এখানে শুধু মাত্র সম্পত্তি নয় পরিবারের সুরক্ষার ব্যাপারটিও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে ববেচিত হয় ।

বাংলাদেশের আইনি ফ্রেমওয়ার্ক:

মুসলিম পারিবারিক আইন:

উত্তরাধিকার সূত্রের হিসেব : পুত্র ২ অংশ, কন্যা ১ অংশ পাবে (কুরআনের বণ্টন নীতি)।

তবে, মায়ের সম্পত্তিতে সব সন্তান সমান অধিকার পায়।

উইল : ইসলামিক আইনে একজন ব্যক্তি তার সম্পত্তির সর্বোচ্চ ১/৩ অংশ উইলের মাধ্যমে বণ্টন করতে পারেন (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১)।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে :

দায়ভাগা নীতি : পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের কোন অধিকার নেই (হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬)।

শুধুমাত্র পিতা যদি স্বয়ং অর্জিত সম্পত্তি উইল করে যান, তবেই মেয়েরা সেখানে ভাগ পায়।

সদ্য পরিবর্তন : ২০২৩ সালে হাইকোর্ট একটি রায়ে বলেছেন, হিন্দু নারীরা পৈতৃক সম্পত্তিতে অংশ পেতে মামলা করতে পারেন, কিন্তু আইন এখনও সংশোধিত হয়নি।

খ্রিস্টান অন্যান্য :

১৯২৫ সালের “সাকসেশন অ্যাক্ট” অনুযায়ী, সব সন্তান সমান অংশ পায়। তবে, যদি উইল না থাকে, সম্পত্তি সরকার দখল করতে পারে।

সংকটের মূল কারণ:

সংকটের মূল কারণ হিসেবে আমরা চিহ্নিত করেছি –

দলিল রেজিস্ট্রেশনের জটিলতা : জমি রেকর্ড এখনও ৮০% ম্যানুয়াল (ভূমি মন্ত্রণালয়, ২০২৩)।

আগের থেকে অনেকটা ডিজিটাল হলেও এখনো অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।

মুসলিম আইনে উইলের সীমাবদ্ধতা : ১/৩ অংশের বেশি উইল করা গেলে সেটা অবৈধ ভাবে দেখা হয়।

হিন্দু নারীদের আইনি সুরক্ষার অভাব।

 

বাস্তব জীবনের লড়াই: মামলা, দুর্নীতি, ও সামাজিক নিপীড়ন :

কেস স্টাডি ১: মালয়েশিয়ার প্রবাসী শাহিনুরের (ছদ্মনাম) শুধু এক মেয়ে। তার চাচা ৫০ শতক জমি দখল করে “মেয়ে উত্তরাধিকারের অধিকার নেই” বলে দাবি করেন। আদালতে গেলে উকিল বললেন, “মুসলিম আইনে মেয়ে তো অর্ধেক পায়, তাহলে মামলা করবেন?”

মামলার ৩ বছর পর আদালত রায় দিয়েছে, কিন্তু জমি এখনও তাদের দখলে।

কেস স্টাডি ২ : হিন্দু পরিবারের রীতা দাস (ছদ্মনাম) পৈতৃক জমির দাবি করে মামলা করায়, গ্রামের লোকেরা তার বাবাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করে। তাদের মতে,বিয়ের পরে মেয়েরা বাবার বাড়ির আর কিছুই পাবেনা।

স্ট্যাটিস্টিকস :

সম্পত্তি মামলার গড় সময়: ৭ বছর (সুপ্রিম কোর্ট, ২০২২)।

জমি অফিসে দুর্নীতির হার: ৬৩% (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ২০২৩)।

সমাধানের রোডম্যাপ: আইন, প্রযুক্তি, সামাজিক আন্দোলন

আইনি পদক্ষেপ :

উইল রেজিস্ট্রেশন : প্রবাসীরা অনলাইনে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে উইল তৈরি করতে পারেন,যেটি এখন অনেকটা হাতের নাগালে। (ই-নথি সার্ভিস, ভূমি মন্ত্রণালয়)।

জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি (GPA) : শুধু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য “স্পেশাল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি” দিন, যা পরে বাতিল করা সম্ভব, যা বিদেশে বসেও করা সম্ভব ।

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার :

ডিজিটাল খতিয়ান : ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ (dlrs.gov.bd) থেকে জমির সঠিক রেকর্ড চেক করুন নিয়মিত।

ব্লকচেইন টেকনোলজি : ভারত ও ইউএইতে জমি রেকর্ডের জন্য ব্যবহৃত এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে চালু হতে যাচ্ছে, যা জালিয়াতি রোধ করতে অনেকটা সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারবে।

সামাজিক উদ্যোগ :

গ্রামীণ নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা : স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসায় সম্পত্তি অধিকার বিষয়ক জনসচেতনতা মূলক পদক্ষেপ তুলে ধরতে হবে ।

মিডিয়া ক্যাম্পেইন : ধারাবাহিক নাটক বা টক শো-র মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে । (যেমন: চ্যানেল আই-এর “অধিকার” প্রোগ্রাম)।

প্রবাসীদের জন্য এক্সপার্ট টিপস আমাদের পক্ষ থেকে :

  • জমির সকল ডকুমেন্ট স্ক্যান করে গুগল ড্রাইভে সেভ করুন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করুন।
  • বছরে একবার স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে খাজনার রশিদ নিন এবং আপনার প্রতি বছরের খাজনা সময়মতো দিয়েছেন কিনা খোজ নিন।
  • নারী সদস্যদের নামে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করুন – এটি আইনী সুরক্ষা বাড়ায়।

সরকারি বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা :

ভূমি মন্ত্রণালয় চালু করেছে হেল্পডেস্ক (১৬১২), যেখানে SMS-এ জমি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK) বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে  (যোগাযোগ: ০১৭১৩-৪৮০৪৮০)।

ব্র্যাকের “লিগ্যাল এইড” প্রোগ্রাম গ্রামীণ নারীদের সম্পত্তি অধিকার শেখানো হয়।

ভবিষ্যতের আহ্বান: যে পরিবর্তন প্রয়োজন :

স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন: শুধুমাত্র প্রবাসীদের সম্পত্তি মামলার জন্য দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যাতে করে পরবর্তীতে ভোগান্তি কম হয়।

পরিশেষে,বলা যায়,প্রবাসীদের সম্পত্তি নিয়ে সচেতন থাকতে হবে, সম্পত্তি যেনো নিজের জন্যই আশান্তির কারন না হয় কিংবা আত্মীয় স্বজনের দ্বারা যেন  দুঃচিন্তার কারন না হয়, বিশেষ করে শুধু কন্যা সন্তান থাকলে।

এক্ষেত্রে প্রবাসীদের স্মার্ট সলিউশন বেছে নেয়ার মতন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমরা উৎসাহিত করছি।

আজকাল অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে,আপনার অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণ আইন মোতাবেক আপনার সব সম্পত্তি থেকে শুরু করে আপনার সম্পত্তির যত ধরনের বিষয় সব কিছু দেখাশুনা করবে এবং আপনাকে সময়মতো সব তথ্য পাঠাবে।

প্রবাসিদের সম্পত্তি সংক্রান্ত আরও তথ্য পেতে নিয়মিত www.profitabd.com এর ব্লগে আপডেট থাকতে পারেন , বা প্রফিটা বিডির ফেসবুক পেজ www.facebook.com/bdprofita তেও কানেক্টেড  থাকতে পারেন ।

যে কোন প্রয়োজনে বা তথ্যের জন্যে নিচের ইমেইল এড্রেসে আমাদের মেইল করতে পারেন ।

care.profita@gmail.com

সবচেয়ে বড়কথা নিজ থেকে সচেতন হওয়ার বিকল্প কিছুই হতে পারেনা ।

 

Spread the love

Join The Discussion

One thought on “প্রবাসীদের দেশের সম্পত্তির প্রতি অসচেতনতা , সমস্যা ও প্রতিকার :”

  • admin

    খুবই প্রাসঙ্গিক লিখা । ধন্যবাদ প্রফিটা বিডি কে । আশা করি এই আর্টিকেল টি প্রবাসি দের অনেক কাজে আসবে ।

    Reply